মরমী বুল্লেশাহ্
পাঞ্জাবী সাধক সৈয়দ আবদুল্লাহ শাহ্ কাদরি ‘বুল্লে শাহ্’ বা ‘বুল্লা’ শাহ্। অষ্টাদশ পাঞ্জাবের মরমী কবি। পাঞ্জাবের মহাত্মা লালনও বলা যেতে পারে তাঁকে। বুল্লে শাহের জন্মসাল ধরা যেতে পারে ১৬৮০ খ্রিস্টাবে বা তার পরে।
বুল্লে শাহ পাঞ্জাবের ভাওয়ালপুরের ‘উচ’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামটি ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের অংশে পড়েছে। যতদূর জানা যায়, বাবা বুল্লে শাহের পূর্বপুরুষ বুখারা থেকে এসেছিলেন। যার বর্তমান নাম উজবেকিস্থান।
জনশ্রুতি আছে, বুল্লে শাহের পুর্বপুরুষেরা নবী এর বংশধর ছিলেন। তার বাবার নাম শাহ মোহাম্মদ দরবেশ।
বুল্লে শাহ কবিতা লিখতেন। বুল্লে শাহ্-র কবিতাগুলো কাফি ঘরানার। এটি একটি পাঞ্জাবি ঘরানার রাগ, সিন্ধি এবং সিরাকি কবিতা। পাঞ্জাব এবং সিন্ধে এ ধরনের কবিতার চল রয়েছে। মুর্শিদ তথা গুরু বা পথ প্রদর্শক এবং মুরিদ তথা অনুগামীর মধ্যে কথোপকথন নিয়ে এই কবিতা রচিত হয়।
এই মুরিদ কখনও মানুষ আর মুর্শিদ হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। আবার কখনও প্রেমিক-প্রেমিকা।
কাফি শুধু সুফি, সিন্ধি এবং পাঞ্জাবিদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতো না। বরং শিখ গুরুরাও কাফি লিখতেন।
বুল্লে শাহ শুধু কবি ছিলেন তাই নয়; তিনি একজন দার্শনিকও! যার প্রমাণ তার ছোটবেলাতেই পাওয়া যায়। ঘটনাটা ঘটনাটা বলবার জন্যই আসলে এই লেখা। অন্য কথায় না গিয়ে সেই ঘটনার কথাই বরং বলা যাক-
বেশ ছোটবেলাতেই বুল্লে শাহ্-কে পাঞ্জাবের একটা বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। তাঁর বয়সী বাচ্চাদের সাথে তিনিও বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা শুরু করেন। সব ঠিক থাকেলও সমস্যা শুরু হয়ে যায় ‘আলিফ’ শব্দটিকে নিয়ে! বুল্লে শাহ ‘আলিফ’ শব্দটিতেই আটকে যায়।
তাঁর শিক্ষক কোন ভাবেই তাঁকে বাকি বর্ণমালা চেনাতে পারছিল না! এক সপ্তাহ চলে গেল, তাঁর বন্ধু-বান্ধব তত দিনে আরবী বর্ণমালা সব পড়ে শেষ করলেও তিনি আরবী প্রথম শব্দেই আটকে থাকলেন!
এরপর তিনি সেই শিক্ষকের কাছে গেলেন। যিনি তাঁকে পড়াতে অ-স্বীকার করেছিলেন। শিক্ষককের কাছে গিয়ে তিনি মাথা নিচু করে তাঁকে সম্মান করলেন। কিন্তু শিক্ষক তাঁকে চিনতে পারলো না।
‘আলিফ’ এর মধ্যে কি যে পেলেন বুল্লে শাহ তা তিনিই ভালো জানেন!
যাইহোক শিক্ষক বুল্লে শাহর বাবা-মাকে ডেকে বললেন, ‘আপনার ছেলের মানুষিক বিকাশ ঠিকভাবে হয়নি, আপনারা ওকে নিয়ে চলে যান!’
অগত্যা বুল্লে’র বাবা-মা স্কুল থেকে ছাড়িয়ে অন্য এক শিক্ষকের কাছে পাঠালেন। কিন্তু সেখানেও একি অবস্থা! এরপর তারা নানাভাবে নানান জায়গায় তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন লাভ হল না।
বুল্লে’র বাবা-মা হতাশ হয়ে পড়লেন। ছেলেকে নিয়ে পড়লেনন গভীর চিন্তায়।
এতচাপ সহ্য করতে না পেরে বুল্লে শাহ একদিন বাসা থেকে পালিয়ে গেল! যাতে কেউ আর তাঁকে চাপ না দিতে পারে!
তারপর বুল্লে শাহ বনের মধ্যে বাস করতে শুরু করলেন আর ‘আলিফ’ শব্দের অর্থ খুঁজতে লাগলেন। কয়েকদিন যাওয়ার পর তিনি ‘আলিফ’ শব্দের অর্থ খুঁজে পেলেন। সবখানেই দেখছেন ‘এক আলিফ’। অনুভব করছেন ‘এক আলিফ’।
ভাবছেনও ঐ ‘এক আলিফ’ কে নিয়েই! গাছ, গাছের পাতায়, ফুল, ফল, পাহাড়-পর্বত, পোকামাকড়, পশুর মধ্যে সব খানেই তিনি ‘আলিফ’ এর অর্থ খুঁজে পেলেন!
এরপর তিনি সেই শিক্ষকের কাছে গেলেন। যিনি তাঁকে পড়াতে অ-স্বীকার করেছিলেন। শিক্ষককের কাছে গিয়ে তিনি মাথা নিচু করে তাঁকে সম্মান করলেন। কিন্তু শিক্ষক তাঁকে চিনতে পারলো না।
তখন বুল্লে বলে উঠল, ‘আমি আলিফ পড়া শিখে এসেছি। এখন আমি আপনাকে তা লিখে দেখাতে চাই।’
শিক্ষক তখন চিনলেন আর মুচকি হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে বোর্ডে লিখো।’
বুল্লে বোর্ডের মধ্যে প্রথমে একটা বিন্দু বা ফোঁটা দিলো এরপর তিনি একটা লম্বা দাগ টানলেন মানে বোর্ডে উনি ‘আলিফ’ শব্দটি লিখলেন।
প্রথমে বিন্দু এবং পরের টান দিয়ে উনি আলিফ শব্দটিকে দ্বি-খণ্ডিত করলেন এবং এটার ব্যাখ্যা করলেন।
আবার আরবীতে ‘আল্লাহ’ শব্দটি লিখতে হলে আলিফ লাগে। আল্লাহ্ আবার সব কিছুর মালিক সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন। অতএব যা কিছু আজ আমরা দেখতে পাই। সব কিছুর সূচনা কিন্তু সেই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকেই। সুতরাং আলিফের বিন্দুর মধ্যেই সকল সৃষ্টির অর্থ লুকাইত আছে!
শিক্ষক শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং খুশি হয়ে বললেন, ‘তুমি একটা বর্ণ আলিফের মধ্যে যা শিখেছ তা আমি সব বর্ণ মুখস্থ করেও তা শিখতে পারি নি।’
এরপর বুল্লে শাহ শ্রেণী কক্ষে বসে থাকা তাঁর বন্ধুদের উদ্দেশ্যে একটা গান ধরলেন। সেই গান নিয়ে পরে আলোচনা করছি।
আগের তার দেয়া ‘আলিফ’ নিয়ে ব্যাখ্যায় আসা যাক। ‘আলিফ’ শব্দটি লিখতে হলে সবার আগে একটা ফোটা বা বিন্দু দিয়ে ‘আলিফ’ লিখতে হয়। এই ফোঁটা বা বিন্দুটি দেখতে অঙ্কের শূন্যের মত; যার অর্থ কিছুই না। প্রতিটি সৃষ্টির শুরু হয়েছে বিন্দু থেকে যার আগে কিছুই ছিল না!
এমনকি বিজ্ঞানীরাও বলছেন, শূন্য বিন্দু থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি। শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী, শূন্য বিন্দুর মোট শক্তির পরিমাণ হবে শূন্য!
বিগব্যাং থিউরিতেও এই বিন্দুর কথা বলা হয়েছে। বিগব্যাং থিওরি অনুযায়ী, মহাবিশ্ব শুরুতে একটা কণারূপে বা বিন্দু ছিল, পরে মহাবিস্ফোরণে এটা বাড়তে শুরু করে!
আলিফ যেহেতু আরবী বর্ণমালার প্রথম শব্দ। তার আগে কোন শব্দ নাই। ঠিক তেমনি আলিফ লিখতে হলে এই বিন্দু দিয়ে শুরু করতে হয়। যার আগেও কিছু নাই। সব শূন্য!
এই বিন্দু দিয়ে যেমন আলিফ লেখাটা শুরু। ঠিক তেমনি ভাবে বিন্দু থেকেই সকল কিছুর সৃষ্টি হয়েছে!
আবার আরবীতে ‘আল্লাহ’ শব্দটি লিখতে হলে আলিফ লাগে। আল্লাহ্ আবার সব কিছুর মালিক সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন। অতএব যা কিছু আজ আমরা দেখতে পাই। সব কিছুর সূচনা কিন্তু সেই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকেই। সুতরাং আলিফের বিন্দুর মধ্যেই সকল সৃষ্টির অর্থ লুকাইত আছে!
সেকারণেই আলিফ শব্দটি বিশাল তাৎপর্য বহন করে!
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত করন জোহর পরিচালিত ‘অ্যায় দিল হ্যাঁয় মুশকিল’ সিনেমায় ‘বুল্লেয়া’ শীর্ষক গানে এই বুল্লে শাহ্-র কথাই বলা হয়েছে এবং তাকে ‘প্রেমিকের বন্ধু’, ‘পথ প্রদর্শক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
বুল্লে শাহ্-র নাম আধুনিক মানুষের কাছে প্রথমে আসে ১৯৯০ সালে। যখন পাকিস্তানী ব্যান্ড ‘জুনুন’ তার ‘বুল্লা কি জানা’ কবিতাটিকে গানে পরিণত করে।
২০০৪ সালে রাব্বি শেরগিল তার প্রথম অ্যালবাম ‘রাব্বি’-তে এই গানটি নতুন করে গেয়েছিলেন। যা ২০০৫ সালে টপচার্টে ছিল।
বুল্লে শাহ্-র কবিতা থেকে বলিউডেও প্রচুর গান হয়েছে। তার কিছু কিছু জানলে অনেকেই হয়তো অবাক হবেন। ‘মেরা পিয়া ঘার আয়া’ বুল্লাহ্-র সৃষ্টি। যে কোন অনুষ্ঠানে উপমহাদেশে খ্যাতিমান শিল্পী রুনা লায়লা একটা গান গেয়েই থাকেন- ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ গানটি।
এটিও বুল্লে শাহ্-র একটি কবিতা। যা থেকে কাওয়ালী গাওয়া হয়। যা বুল্লে শাহ্ শাহবাজ কালান্দার নামক আরেকজন সুফি সাধকের সম্মানে লিখেছিলেন। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া মণি রত্নমের ‘রাবণ’ সিনেমার ‘রাঞ্ঝা রাঞ্ঝা’ গানের রচয়িতা বুল্লে শাহ্।
এবং তার রচিত পাঞ্জাবী কবিতা ‘তাহাইয়া তাহাইয়া’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই গুলজার, এ আর রহমান এবং মণি রত্নম কালজয়ী গান ‘ছাইয়া ছাইয়া’ তৈরি করেন।
বুল্লে শাহ্-কে ধারণ ও তার কবিতা থেকে গান গেয়ে যারা তাকে অমর করে রেখেছেন। তাদের মধ্যে আবিদা পারভিন এবং সাই জহুরের নাম সর্বাগ্রে আসে।
এছাড়াও নুসরাত ফতেহ্ আলী খাঁ, শাবরি ব্রাদার্স, ওয়াদালি ব্রাদার্সের নাম বলতে হয়। কোক স্টুডিওর গুনে আধুনিক মানুষের মনেও তিনি ছাপ ফেলছেন।
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত করন জোহর পরিচালিত ‘অ্যায় দিল হ্যাঁয় মুশকিল’ সিনেমায় ‘বুল্লেয়া’ শীর্ষক গানে এই বুল্লে শাহ্-র কথাই বলা হয়েছে এবং তাকে ‘প্রেমিকের বন্ধু’, ‘পথ প্রদর্শক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই
হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্ বাবা
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ
বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার
উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি
বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন
2 Comments