ভবঘুরেকথা
মনসুর হাল্লাজ ফকির

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই

-মূর্শেদূল মেরাজ

মনসুর হাল্লাজের আত্মোপোলব্ধি

২৭০ হিজরিতে হাল্লাজ হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় যান। মক্কায় তিনি এক বছর সময় অতিবাহিত করেন। এই পুরো সময়কালে তিনি প্রায় কোনো প্রকার আহার না করে, সর্বক্ষণই কাবার দিকে মুখ করে ধ্যানরত অবস্থায় নিশ্চুপ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতেন।

দেহের কাপড়, পায়ের জুতা, মাথার কাপড় কোনো কিছুর প্রতিই তিনি স্বজাগ থাকতেন না। কেবল কাবার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। জনশ্রুতি আছে, এ সময় প্রতিদিন জনৈক ব্যক্তি কয়েকটি রুটি ও এক পাত্র পানি তার সামনে রেখে যেতে। হাল্লাজ কদাচিৎ রুটির কিছু অংশ খেতেন বা সামান্য পানি পান করতেন।

অভুক্ত থাকতে থাকতে এ সময় তার দেহ শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে যায়। উৎসাহী মানুষ ভিড় করে তাকে দেখতে আসতো। কেউ কেউ মন্তব্য করতো। তিনি প্রায় কিছুই বলতেন না।

কিছুদিন পর ইয়াকুব-ই-নারাজুরি নামের এক ব্যক্তি হাল্লাজকে একজন জাদুকর-মানুষিক বিকারগ্রস্ত ও ধর্মবিরোধী বলে প্রচার করতে শুরু করেন। এতে উপস্থিত লোকজন উৎসাহ পান। তারা হাল্লাকে উত্যক্ত করতে আরম্ভ করে।

তাদের নানাবিধ উত্তপ্ত মন্তব্যে ধ্যানভঙ্গ হলে হাল্লাজ ক্ষুব্ধ হয়ে চিৎকার করে স্রষ্টার কাছে অভিযোগ করে বলতেন, ‘হে প্রভু! আমি যদি প্রকৃত খোদাপ্রেমী হয়ে থাকি, তাহলে আপনি এই বিভ্রান্ত উত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও।’

কিন্তু রাতের একাকীত্বে তিনি স্রষ্টার কাছে কোমল স্বরে নত হয়ে প্রার্থনায় বলতেন- ‘হে প্রভু! আমি জানি আপনি ভিন্ন আমার কোনো উপাস্য নেই। আপনি আমার পক্ষে থাকার জন্য কৃতজ্ঞ। আমি কারো প্রতিই কোনো বিষেদাগার প্রকাশ করতে চাইনি। হে প্রভু! আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’

এভাবে বছরখানেক অবস্থানের পর হাল্লাজ মক্কা নগরী থেকে বাগদাদে ফিরে আসেন। বাগদাদে কিছুদিন কাটিয়ে ২৮৪ হিজরিতে তিনি দীর্ঘ সফরের উদ্দেশ্যে বের হন। এ সফরে তিনি খোরাসান, তুর্কিস্থান, চীন, সিন্ধু, ভারত প্রভৃতি অঞ্চল ঘুরে ঘুরে তার দর্শন প্রচার করেন। মানুষকে শিক্ষাদানের এ সময় পাশাপাশি হাল্লাজ নিয়মিত লেখালেখিও শুরু করেন।

এই পুরো সফর জুড়ে প্রচুর মানুষ তার মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়। অনেক শিষ্যও তৈরি হয় তার। যাদের মধ্যে অনেকে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় হজের সফরে সফরসঙ্গীও হন।

এই দীর্ঘ সফর শেষে তিনি আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদে স্থায়ী হন। এবার তিনি বাগদাদে তার মতাদর্শ প্রচার শুরু করেন। বাগদাদে সুফিচর্চার ধারা পূর্ব থেকেই প্রচারিত থাকলেও হাল্লাজকে ঘিড়ে তা নতুন মাত্রা পায়। তার অদ্ভুত জীবন যাপনের কারণেও তাকে নিয়ে নানা কাহিনী ছড়িয়ে পরে।

স্রষ্টাকে তিনি নিজের প্রেমিক, বন্ধু, সাথি বলে উল্লেখ করতেন। যেটা সে সময়ের সমাজব্যবস্থায় কল্পনাও করা যেত না। হাল্লাজ তার সাধন-ভজনে ছিলেন একনিষ্ঠ। খোদার ধ্যানে তিনি এমনই মশগুল হয়ে থাকতেন যে, অনেক সময় নিজের নাম পর্যন্ত মনে করতে পারতেন না।

হাল্লাজের অদ্ভুত প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। এরূপ একটা ঘটনা এমন- তার শিষ্যরা একবার পরামর্শ করলো তাদের গুরু হাল্লাজ যে গত দুই দশক ধরে একই পোশাক পরে আছেন সেটা তারা পরিবর্তন করে দিবে। পোশাকটি এতো ছিন্নভিন্ন অবস্থা ছিল যে তালি দেবারও আর জায়গা অবশিষ্ট ছিল না।

কিন্তু ভক্তরা জানতেন বলে হাল্লাজকে পোশাক পাল্টানোর বিষয়ে রাজি করানো যাবে না। কারণ তারা আগে বহুবার অনুরোধ করেছে কিন্তু হাল্লাজ তাতে মত দেন নি।

পরিকল্পনা মাফিক শিষ্যরা একদিন অনেকটা জোর করে তার জোব্বা খুলে নতুন একটা পোশাক তাকে পরিয়ে দেয়। কিন্তু তারা পুরানো পোশাকটিতে একটি বিচ্ছুর বাসা দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়ে যায়।

হাল্লাজ বলেন, এই বিচ্ছুটি তার সঙ্গী হয়ে গত ২০ বছর ধরে তার পোশাকের মধ্যে বসবাস করে আসছে।

শিষ্যরা তাদের ভুল বুঝতে পারে। তারা সম্মানের সাথে হাল্লাজকে তার পুরানো পোশাকটি ফিরিয়ে দেন। হাল্লাজ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন।

স্বভাবে হাল্লাজ ছিলেন অন্যান্য সুফি সাধক থেকে ব্যতিক্রম। সুফিমতে সাধনায় প্রাপ্ত সত্যকে সাধারণের কাছে গুপ্ত রাখার বিধান থাকলেও তিনি তাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। ফলে তিনি তার লেখনীর মধ্যে গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ করতেন অবলীলায়।

এতে ধর্মীয় শরিয়তি ধারার লোকজন তার বিরোধীতা করতে শুরু করে। তারা তার বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে থাকে।

হাল্লাজ বিশ্বাস করতেন, সাধনবলে খোদার সান্নিধ্য লাভ সম্ভব। সাধনার ঊর্দ্ধরথে সাধক খোদার সাথে লীন হয়ে যায়। মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

স্রষ্টাকে তিনি নিজের প্রেমিক, বন্ধু, সাথি বলে উল্লেখ করতেন। যেটা সে সময়ের সমাজব্যবস্থায় কল্পনাও করা যেত না। হাল্লাজ তার সাধন-ভজনে ছিলেন একনিষ্ঠ। খোদার ধ্যানে তিনি এমনই মশগুল হয়ে থাকতেন যে, অনেক সময় নিজের নাম পর্যন্ত মনে করতে পারতেন না।

হাল্লাজ বলতেন, ‘যদি নিজেকে সবকিছু থেকে বিযুক্ত করা যায়, তাহলে পৌঁছে যাওয়া যায় সেই অলৌকিকতায়, যেখানে কিছুই বিযুক্ত নয় আর, কিছুই নয় সম্পৃক্ত।’

আরো বলতেন, ‘ভালবাসা মানে প্রিয়জনের পাশে দাঁড়ানো, আমিত্বকে বর্জন করে নিজেকে স্রষ্টার রঙে রাঙিয়ে নেওয়া।’

সে আর নিজের মধ্যে ছিলেন না। নিজেকে হারিয়ে আল্লাহর স্বত্তায় মিশে গিয়েছিলেন এবং সর্বময় খোদাকে দেখতে পারতেন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে হাল্লাজ বলতেন, ‘আমার পাগড়িতে শুধু খোদা ছাড়া আর কোনো কিছুই প্যাঁচানো নেই। আমার জামার ভেতরে খোদা ছাড়া আর কেউ নেই।’

তবে সবচেয়ে বিতর্ক শুরু হয় যখন তিনি তার আকিদা হুলুল ও ইত্তেহাদ প্রচার করেন। অর্থাৎ তিনি বলতেন আল্লাহ তার মধ্যে প্রবেশ করেছেন; ফলে আল্লাহ্ ও তিনি একই সত্তা হয়ে গেছেন। এ কথা হাল্লাজ প্রকাশ্যে বলতে শুরু করলে অবস্থা অবনতি হতে শুরু করে। লোকজন ক্ষোভে ফেটে পরে তার উপর।

আল্লাহর সঙ্গে তার মিলিত হওয়ার এই বাসনার কারণে তৎকালীন শরিয়তি আলেমরা তাকে ‘ছদ্মবেশী খ্রিস্টান’ বলে আখ্যায়িত করে।

হাল্লাজ বিশ্বাস করতেন, একমাত্র আল্লাহই পারেন তার নিজের একত্বের ঘোষণা দিতে। মানুষের ইবাদত শুধু তার হুকুমের প্রতিফলন, তার আদেশের সামনে মাথা নত করা।

কথিত আছে, একদিন ধ্যানরত অবস্থায় হাল্লাজ এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে দর্শন করেন। হাল্লাজ বলেন, তুমি কে? তিনি বলেন ‘আনাল হক’। সেই জ্যোতির্ময় রূপ ও বাণীতে হাল্লাজ এতটাই অভিভূত হন যে, তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলতে শুরু করেন ‘আনাল হক’ অর্থাৎ ‘আমিই পরম সত্য’।

হাল্লাজের এই ‘আনাল হক’ বলাকে কেন্দ্র করে তার শত্রুরা প্রচার করে আনাল নিজেকে আল্লাহ দাবি করছে। উল্লেখ্য ‘আল-হক’ হচ্ছে আল্লাহর ৯৯টি নামের একটি। আলেমরা একে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে তাকে ফেরাউনের সাথে তুলনা করেন।

মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘মনসুর হাল্লাজ ‘আমিই খোদা’ বলেছিলেন খোদার সামনে নিজের আমিত্ব মেটানোর জন্যে, আর ফেরাউন ‘আমিই খোদা’ বলেছিলেন নিজের আমিত্বের সামনে খোদাকে মেটানোর জন্যে।

সুফিদের মতে, আল্লাহর সাথে হাল্লাজের নৈকট্য এতটাই গভীর হয়ে উঠেছিল যে, তিনি নিজেকে খোদা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতেন না। তাই তিনি নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। তার পরিবর্তে নিজেকে ‘আনাল হক’ বলে পরিচয় দিতেন।

সে আর নিজের মধ্যে ছিলেন না। নিজেকে হারিয়ে আল্লাহর স্বত্তায় মিশে গিয়েছিলেন এবং সর্বময় খোদাকে দেখতে পারতেন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে হাল্লাজ বলতেন, ‘আমার পাগড়িতে শুধু খোদা ছাড়া আর কোনো কিছুই প্যাঁচানো নেই। আমার জামার ভেতরে খোদা ছাড়া আর কেউ নেই।’

তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগও করা হয় যে হাল্লাজ হজ করার বিরুদ্ধে কথা বলেন। যদিও তিনি নিজেই তিনবার হজ পালন করেছেন।

(চলবে…)

<<মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক ।। মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন>>

…………………
আরো পড়ুন:

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!