সোহরাওয়ার্দির প্রেমের বাস্তবতা
-মূর্শেদূল মেরাজ
সোহরাওয়ার্দির প্রেমের বাস্তবতা
বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্রষ্টা প্রেম নিয়ে এ যাবৎ যত বই রচিত হয়েছে তার মধ্যে ‘রিসালাহ ফি হাক্বিক্বাতাল ইশক’ বা ‘প্রেমের বাস্তবতা’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ইউসুফ নবী আর জুলেখা। এ গল্পে মূলত স্রষ্টা থেকে সৃষ্টির বিচ্ছিন্নতা, পৃথিবীতে নির্বাসিত জীবন এবং তার অসহায়ত্বের অবস্থার কথা বলা হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দি বলছেন, স্রষ্টা সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন বুদ্ধিবৃত্তি। এরপর বুদ্ধিবৃত্তিকে দিয়েছেন স্রষ্টাকে, মানুষকে এবং জ্ঞানী অর্থাৎ গুরুকে (সোহরাওয়ার্দিকে) চেনার গুণ। বুদ্ধিবৃত্তির এই তিন গুণ থেকে যথাক্রমে সৌন্দর্য, প্রেম এবং বিরহের সৃষ্টি।
আর এই সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে নিজ সৌন্দর্য থেকেই। তার হাসি থেকে সৃষ্টি হয়েছে ফেরেশতারা। প্রেম-ভালবাসা আর সৌন্দর্যের পারস্পরিক বন্ধন থেকে সৃষ্টি হয়েছে আকাশ ও ভূমণ্ডল। আর এসব ঘটেছে আদমকে সৃষ্টির আগে। যখন আদমের যুগ এলো তখন স্রষ্টা তার প্রতিনিধিকে নিয়োগ দিলেন ভূ-পৃষ্ঠে।
‘সৌন্দর্য’ মাটির আদমের সঙ্গে সফর করতে যেয়ে আদমের সমস্ত অস্তিত্বে ছড়িয়ে পরে। এভাবে অনেক দিন চলে যায়। সৌন্দর্য আর তার নিজ দেশে ফিরে যায় না। ঐ দিকে তার দুই ভাই ‘প্রেম’ ও ‘বিরহ’ উদ্বিগ্ন হয়ে সৌন্দর্যকে খুঁজতে বের হয়।
প্রেম নিজের ও তার ভাইদের গল্প জুলেখার কাছে বলে এবং জগতের সেরা সুন্দর সুলতান ইউসুফ নবীর প্রতি তার ভাই সৌন্দর্য্যের প্রেম নিবেদনের কাহিনীও বর্ণনা করে। প্রেমের সঙ্গে একাকার হওয়া জুলেখা ইউসুফের মধ্যে সৌন্দর্যকে দেখতে পেয়ে তার গভীর প্রেমে পরে যান।
খুঁজতে খুঁজতে একসময় তারা আদমের সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসে থাকা অবস্থায় সৌন্দর্যকে দেখতে পায়। প্রেম, বিরহ, ফেরেশতা ও উর্দ্ধলোকের বাসিন্দারা আদমের মহাগৌরব ও মহত্ত্বে সেজদায় রত হয়।
আদমের পর সৌন্দর্য নিজের জন্য নতুন জায়গা খুঁজতে খুঁজতে ইউসুফ নবীর কাছে পৌঁছে এবং তার মধ্যে প্রবেশ করে। সৌন্দর্য্যের ভাইরাও ইউসুফের মধ্যে প্রবেশের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। কিন্তু তারা কিছুতেই তার মাঝে প্রবেশ করতে পারল না। কারণ ততক্ষণে সৌন্দর্য এবং ইউসুফের মধ্যে আর কোনো পার্থকই ছিল না। দুজনেই মিলেমিশে একাকার।
সৌন্দর্যের দুই ভাই এতে হতাশ হয়ে একে-অপরের দেশের দিকে রওনা হয়। দুঃখ যায় কানানে তথা ফিলিস্তিনে। সেখানে দুঃখের ঘর ইউসুফ নবীর পিতা ইয়াকুব নবীর মাঝে প্রবেশ করে একাকার হয়ে যায়। এই একাত্মতা এত গভীর হয় যে ইয়াকুব দুঃখের কাছে তাঁর দৃষ্টিশক্তিকেও সমর্পণ করেন।
অপর ভাই ‘প্রেম’ যেতে যেতে মিশরে পৌঁছে। সেখানে সে মিশর প্রধানের স্ত্রী জুলেখার সন্ধান করতে থাকে। জুলেখা প্রশ্ন করে, তুমি কে কোথা থেকে এসেছ? প্রেম বলে, আমি বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে এসেছি। আমার ঠিকানা হল ‘রুহাবাদ’ এবং বাড়ির নাম হলো ‘সৌন্দর্যের বাড়ি’। ভ্রমণ আমার পেশা।
প্রেম নিজের ও তার ভাইদের গল্প জুলেখার কাছে বলে এবং জগতের সেরা সুন্দর সুলতান ইউসুফ নবীর প্রতি তার ভাই সৌন্দর্য্যের প্রেম নিবেদনের কাহিনীও বর্ণনা করে। প্রেমের সঙ্গে একাকার হওয়া জুলেখা ইউসুফের মধ্যে সৌন্দর্যকে দেখতে পেয়ে তার গভীর প্রেমে পরে যান।
ইউসুফ মিশরের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এই খবর শুনে ইয়াকুব তার অন্য সন্তানদেরকে নিয়ে মিশরের দরবারে উপস্থিত হন। ইয়াকুব নবী দেখেন ইউসুফ-জুলেখা রাজ সিংহাসনে বসে আছে। তাদের একজন হয়ে গেছে ‘চরম সৌন্দর্য্য’ আর অন্যজন ‘চরম প্রেম’।
মানুষ হচ্ছে সেই গাছ যা আত্মা বা হৃদয়ের বীজ থেকে উর্ধ্বজগতে গজিয়ে ওঠে। দেহ হল সেই আশ্চর্য গাছের বিপরীত। প্রেম সেই পরগাছার মত যা মানুষকে প্যাঁচিয়ে ধরে মানবতার সব রসটুকু ভোগ করে। আর এভাবে তা মানুষকে পৌঁছে দেয় অমরত্বের জগতে ও দেহটাকে রেখে যায় ধ্বংসময় জগতে।
ইয়াকুব নবীর সঙ্গে আসা ‘দুঃখ’ বা ‘বিরহ’ তার দুই ভাইয়ের মুখোমুখী হয়। এভাবে তিন ভাই প্রেম, দুঃখ ও সৌন্দর্য আবারও পরস্পরের দেখা পায়। আর এখানেই শেষ হয় গল্পটি।
বইতে প্রেম শব্দটির ব্যাখ্যা দেয়ার পর সোহরাওয়ার্দি বলছেন– মানুষের উচিত আধ্যাত্মিক প্রেম খুঁজে নেয়া ও প্রেমকে প্রেমাস্পদের কাছে উৎসর্গ করা। কারণ প্রেমের মাধ্যমেই প্রেমিকের প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলন ঘটে। তাই প্রেম ও তার নানা স্তর সম্পর্কে জানতে হবে।
‘ইশক্’ শব্দটি এসেছে ‘আশাকাহ্’ শব্দ থেকে যা একটি গাছের নাম। গাছটি অন্য বড় গাছকে জড়িয়ে ধরে তা থেকে পানি নেয় ও এর ফলে তা হলুদ হয়। ইশক লতার শোষণের কারণে মূল গাছটির পাতা ঝরে পড়ে। এক সময় শুকিয়ে যায়।
মানুষ হচ্ছে সেই গাছ যা আত্মা বা হৃদয়ের বীজ থেকে উর্ধ্বজগতে গজিয়ে ওঠে। দেহ হল সেই আশ্চর্য গাছের বিপরীত। প্রেম সেই পরগাছার মত যা মানুষকে প্যাঁচিয়ে ধরে মানবতার সব রসটুকু ভোগ করে। আর এভাবে তা মানুষকে পৌঁছে দেয় অমরত্বের জগতে ও দেহটাকে রেখে যায় ধ্বংসময় জগতে।
প্রেমিক হওয়াই মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ দুনিয়া স্বল্পাস্থায়ী, পরকাল চিরস্থায়ী। আর অসীম ও চিরস্থায়ী জগতে পৌঁছার জন্য সব অস্তিত্বের মাশুক বা প্রেমাময় এক স্রষ্টার অনুরাগী হওয়া ও তার সঙ্গ লাভ করা জরুরি। প্রেম কেবল সৌন্দর্য্যরাজির মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে।
(চলবে…)
<<সোহরাওয়ার্দি: উইপোকার আলাপচারিতা ।। সোহরাওয়ার্দি: লাল বুদ্ধিবৃত্তি>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………..
আরো পড়ুন:
সোহরাওয়ার্দি: জীবন ও কর্ম
সোহরাওয়ার্দি: ইশরাকি দর্শন
সোহরাওয়ার্দি: সাহিত্য
সোহরাওয়ার্দি: জিব্রাইলের পালকের শব্দ
সোহরাওয়ার্দি: উইপোকার আলাপচারিতা
সোহরাওয়ার্দি: প্রেমের বাস্তবতা
সোহরাওয়ার্দি: লাল বুদ্ধিবৃত্তি
সোহরাওয়ার্দি: সী-মোরগের দূত
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com
………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই
হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্ বাবা
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ
বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার
উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি
বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন