গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব চোদ্দ
‘প্রমত্তা পদ্মার স্রোতে’
-মূর্শেদূল মেরাজ
রোদ একটু একটু করে বাড়ছে। এবার জলে নামার পালা। রিয়াদ গিয়ে গাছের উপরে বসে আছে। আমরা হাঁটাহাঁটি করছি বটের ছায়ায়। এমন মায়ার পরিবেশ। তাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না কিছুতেই। তারপরও জলে ডুবার বিষয়টাও টানছে।
শেষমেষ হাঁটা দিলাম। চায়ের কাপ ফেরত দিতে গিয়ে দেখা গেলো বলিষ্ট দেহের দোকানী সিংগারা ভাজার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মুরগির মাংস দিয়ে সিংগারা আলুর মণ্ড রান্না চলছে। এই রূপ দেখে না খেয়ে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হতে পারে না। আমরা জল থেকে উঠে এই সিংগারা খাবোই খাবো।
দোকানিকে আমাদের জন্য সিংগারা রাখার কথা বলে জলে ডুবতে চলে গেলাম। এই যাত্রায় জলে ডুবাডুবি বেশ হলো। পাগলের জলে ডুবে তো আর উঠতেই মন চাইছে না। তার উপর আজ একটা বিশেষ দিন। একই সাথে জন্মাষ্টমী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন। আবার বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আবির্ভাব দিবস।
বাবা লোকনাথও আমার মনের মানুষ। পাগল যেমন। আসলে প্রেমের মানুষরা মনে বসবাসের জায়গা ঠিকঠাক করেই নেয়। মত-পথের সংস্কার ভেদ করে তারা আসন করে থাকেই মনে। এই জায়গায় সাত্তার বাজানের গানটা খুব মনে পড়ে- “প্রেমের মানুষ চিনে নারে অরসিকে”।
এই বর্ষায় থৈ থৈ জলে খাল ফুলেফেঁপে উঠেছে। খালের ওপারে সবুজ গ্রাম। বৃষ্টির জলে সব চকচক করছে। আর ডান পাশে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। অপরূপ সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে টেকেরহাটে পৌঁছে গেছি বুঝতে পারি নাই।
অনেকটা সময় নিয়ে জলে ডোবাডুবি করে যখন উঠলাম ততক্ষণে তিনটা বেজে গেছে। রিয়াদ বলেছিল একটার সময় বেড়িয়ে পরবে। কিন্তু তা কি আর হয়। যার জায়গায় অবস্থান করছি সে না ছাড়লে নড়বার উপায় আছে কি? এখানে সব চলে প্রেমের নিয়মে। প্রেমের বন্ধনে।
যাক শেষে জন্মদিনে কৃষ্ণ আর লোকনাথ বাবাকে বিশেষ ভক্তি দিয়ে। পাগলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুবোল দা’কে নিয়ে চললাম বাজারের পথে। সুবোল দা’কে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মোটেও সহজ নয়। যার সাথে দেখা হয়। তার সাথেই আলাপে জমে উঠেন।
এভাবে এগুতে এগুতে পেছাতে পেছাতে একসময় বাজারে গিয়ে সুস্বাদু হাঁসের মাংসের রসালো তরকারি যোগে সেবা নিলাম। শেষ পাতে দই নিয়ে তবে উঠে পরলাম। এবার বেড়িয়ে পরতে হবে। অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
এবারের যাত্রা আবার টেকেরহাট। আবারো মাহেন্দ্রযোগ। এই পথটা মাঝে মাঝে একটু আধটু ভাঙ্গা হলেও। দুই পাশের পরিবেশ নয়ন জুড়ানো। মন ভোলানো। বিশাল বিশাল গাছের মাঝ দিয়ে চলে গেছে পিচ ঢালা পথ। ডান পাশে রাস্তার পাশ দিয়ে চলে গেছে খাল।
এই বর্ষায় থৈ থৈ জলে খাল ফুলেফেঁপে উঠেছে। খালের ওপারে সবুজ গ্রাম। বৃষ্টির জলে সব চকচক করছে। আর ডান পাশে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। অপরূপ সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে টেকেরহাটে পৌঁছে গেছি বুঝতে পারি নাই।
এবার বিচ্ছেদের কাল। রিয়াদ চলে যাবে আবার কাঁটাখালি আমরা জাজিরা। রিয়াদকে বিদায় দিয়ে আমরা বাসে উঠে বসলাম। সাই সাই করে বাস চললো ভাঙ্গা হাইওয়ে ধরে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জাজিরা। ঘাটে আসতেই লঞ্চ ছেড়ে দিলো।
তারপর সারেং বললো, সবাই চুপ করেন। নড়াচড়া কইরেন না। আগে পিলারটা পার হই। এইখানে… এই স্রোতে… ফেরিই ঠিক থাকতে পারে না। আমারটা তো ছোট্ট লঞ্চ। ফেরি বাড়ি লাগলে তো পিলারে ধাক্কা খায়। কিন্তু আমার টা বাড়ি লাগার সাথে সাথে পানির তলে চইলা যাইবো।
লঞ্চে তিল ধারণের জায়গা নেই। সারেং-এর পাশে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে জানতে পারলাম। এটাই আজকের শেষ লঞ্চ। ফেরী তো আগেই বন্ধ। তীব্র স্রোতের কারণে লঞ্চও বন্ধ। আর শেষ লঞ্চ বলে ঘাটে যত মানুষ ছিল সব উঠে বসেছে।
যাওয়ার সময় আমরা পাটুরিয়া দিয়ে প্রচুর ঘুরে নদী পাড় হয়েছিল লঞ্চ। এবার বরাবার যাওয়ার চেষ্টা করলেও লঞ্চকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হচ্ছে না। লঞ্চের একটা মানুষ নড়লেই লঞ্চ দুলে উঠছে। আর স্রোতের নানামুখি বিচিত্র আচরণ রীতিমত ভয়ঙ্কর।
নবীন সারেং নিজেই আছেন চরম আতঙ্কে। মাঝে মাঝেই বলতে লাগলেন, ভাই কেউ কথা বইলেন না। কেউ চড়াচড়া কইরেন না। কেউ সামনে দাঁড়াইয়েন না। সবাই আতঙ্কে কাঁটা হয়ে আছে। সারেং কখনো বলছে ভাই এই দিকে কিছু লোক আসেন। লঞ্চ এদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে।
আবার কখনো বলছেন ঐদিকে যান। লঞ্চ ঐদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে। আমরাও দেখছিলাম প্রমত্তা পদ্মার ভয়ঙ্কার রূপ। ঢেউ তেমন না থাকলেও স্রোতের সে কি টান। আমার পাশের দুই ভদ্রলোক বিড়বিড় করে সুরা পড়তে শুরু করেছেন। আর শেষ বিকেলের সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে অপরূপ রং ছেড়েছে।
এরই মাঝে টিংটিং-এ ছোকড়া তিড়িংবিড়িং করে কফি বিক্রি করে চলেছে। সে নড়াচড়া করলেই লঞ্চের সামনের যাত্রীরা হৈহৈ করে উঠছে। সকলের এক কথা এক জায়গায় চুপ করে বস। আগে ক্যানলটা পাড়ি দেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
ক্যানেলের দিকটায় স্রোত বেশি তীব্র। তার সামনেই পদ্মা সেতুর পিলার। তার মাঝ দিয়ে যেতে হবে। সারেং উঠে দাঁড়িয়েছে। মানুষজন বলছে, আল্লাহর নাম নিয়ে শান্তভাবে চালান। আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ ভরসা। সারেং-এর চোখে মুখে আতঙ্ক দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় আমাদের সলিল সমাধি হবে।
তারপর সারেং বললো, সবাই চুপ করেন। নড়াচড়া কইরেন না। আগে পিলারটা পার হই। এইখানে… এই স্রোতে… ফেরিই ঠিক থাকতে পারে না। আমারটা তো ছোট্ট লঞ্চ। ফেরি বাড়ি লাগলে তো পিলারে ধাক্কা খায়। কিন্তু আমার টা বাড়ি লাগার সাথে সাথে পানির তলে চইলা যাইবো।
এইবার সবাই দোয়া-দুরূদ বাড়িয়ে দিলো। অনেকে সারেংকে ভরসা দিতে লাগলো। কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও কিছু মানুষ লঞ্চের এই মাথা থেকে ঐ মাথা করতেই লাগলো। আমি দেখেছি কিছু মানুষ আছে। যারা কোথাও স্থির থাকতে পারে না।
বাসায় ফিরে মাঝরাতে দুইজনে কাগজ-কলম নিয়ে হিসেব করে দেখলাম গাবতলী থেকে গুলিস্তানের এই চক্র যাত্রায় আমরা পাড়ি দিয়েছি প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। গাবতলী থেকে গুলিস্তানের শহুরে দূরত্ব ১২/১৩ কিলোমিটার হলেও আমরা দশদিনে ৬০০ কিলোমিটারে এই যাত্রা আপাতত সমাপ্তি টানলাম।
বাসে বসলেও। কখনো এই সীটে কখনো ঐ সীটে। লঞ্চে উঠলে বিনা কারণেই বিশাল বিশাল ব্যাগ পত্র নিয়ে কখনো সামনে কখনো পিছনে। কখনো উপরে কখনো নিচে যাতায়াত করতেই থাকে। কি জানি তাদের জীবনের মোটোই হয়তো এমন। চলমান ধারিত্রীতে সবসময় চলমান থাকতে হবে।
সব ভয় আতঙ্ক কাটিয়ে অতি কষ্টে সারেং যখন লঞ্চখানা তীরে ভিড়াতে সক্ষম হলো। তখন সবাই স্বস্তির নি:শ্বাস ছাড়লো। পাড়ে প্রচুর মানুষ অপেক্ষায় আছে। কিন্তু লঞ্চ আজকের মতো বন্ধ এই স্রোতে আর রাতের অন্ধকারে চলাচল হবে না। অসহায় মানুষগুলো কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
আমরাও যদি আর কয়েক মিনিট দেরি করতাম তাহলে হয়তো আমাদের অব্স্থাও ঐ পাড়ে একই হতো। অবশেষে আমরা পদ্মা পাড়ি দিয়ে চলেই আসলাম রাজধানীর দিকে। আবার সেই নাগরিক যন্ত্রণা-যাতনা। কি আর করা। এইটুকু তো মেনে নিতেই হবে। বাধ্য হয়ে মেনে নিতেই হয়। আমি বাস খুঁজছিলাম চোখে চোখে।
আশিক অবশ্য সেই যাওয়ার পথে ইলিশের অতৃপ্তির কথা ভুলতে পাড়ে নাই। সে ইলিশ খাওয়ার প্রস্তাব দিলো। দুপুরের সেবা এখনো হজম হয়নি। এর মাঝে আবার কি করে খাবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তারপরও ইলিশ বলে কথা। একটু ব্যবস্থা করলে নিশ্চয়ই খেয়ে নেয়া যাবে।
তাই আমরা পদ্মা পাড়ের সেই দোকানের খোঁজে পা বাড়ালাম। নদীর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে বসে ইলিশ খাওয়ার মজাই আলাদা। বড় বড় হোটেলের দামী দামী খাবারে তেমন আকর্ষণ নেই আমার। সেই মানও আমার নেই। পথের পাশের ভাঙ্গাচোরা দোকানের খাবারে আমার অঘাৎ ভক্তি।
গতবারের সেই হোটেলখানার অস্তিত্ব না পাওয়া গেলেও। সেই রূপ ভাসমান হোটেল পাওয়া গেলো। প্লেট ভর্তি ইলিশ নিয়ে বসে পড়লাম। খেতে পারবো না ভাবলেই কম খেলাম বলা যাবে না। বরং বলা যায় মনের আশ মিটিয়ে ইলিশ খেয়ে যাওয়ার পথে স্বাদহীন আর অতিরিক্ত দাম রাখা সেই ইলিশের শোধ যেন নেয়া হলো এই সেবায়।
বাসায় ফিরে মাঝরাতে দুইজনে কাগজ-কলম নিয়ে হিসেব করে দেখলাম গাবতলী থেকে গুলিস্তানের এই চক্র যাত্রায় আমরা পাড়ি দিয়েছি প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। গাবতলী থেকে গুলিস্তানের শহুরে দূরত্ব ১২/১৩ কিলোমিটার হলেও আমরা দশদিনে ৬০০ কিলোমিটারে এই যাত্রা আপাতত সমাপ্তি টানলাম।
আবার নতুন করে যাত্রার বাসনায়। সাধুগুরুপাগল সর্বচরণে ভক্তি দিয়ে এই লেখা এখানেই সমাপ্তি। এই যাত্রায় ও এই লেখা কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থী। সাধুগুরুগাপলভক্ত সর্ব চরণে পাপীর মস্তক দণ্ডপাত।
।। জয়গুরু ।।
(সমাপ্ত)
<<গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব এক ।। ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………….
আরও পড়ুন-
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব এক
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব দুই
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব তিন
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব চার
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব পাঁচ
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব ছয়
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব সাত
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব আট
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব নয়
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব দশ
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব এগারো
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব বারো
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব তেরো
গাবতলী টু গুলিস্তান ৬০০ কিলোমিটার : পর্ব চোদ্দ
………………………..
আরও পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে : পর্ব এক
শাহান শাহ্’র দরবারে – পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : এক
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- এক
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- দুই
টকিমোল্লায় গানে আসর
ফর্সা হাজীতে আরেক দফা
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-এক
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-তিন
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-চার
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-পাঁচ