ভবঘুরেকথা
বাবা জাহাঙ্গীর

বাবা জাহাঙ্গীর

-জহির আহমেদ

তাঁর লেখা ‘মারেফতের গোপন কথা’ বইয়ের সাথে কৈশোরেই আমার প্রথম পরিচয়। আমার মা’ও একজন আধ্যাত্মিক সাধিকা। আম্মার কাছে ও আমার এক দাদা মোখলেস শাহর কাছে শুনে শুনে তখন থেকেই এ ব্যাপারে আমার আগ্রহ।

খুব সম্ভব আমাদের গ্রামের আরেক বুজুর্গ আনসার আলী ফকিরের বাড়ি থেকে পড়ার জন্য আম্মা বইটি নিয়ে এসেছিলেন। তখন আমি বইটি দেখি।

একটু বড় হয়ে দেখলাম, সারা বাংলার ফকির বাউল ও তরিকতের সাধকদের মধ্যে বইটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা। নিজেও পড়লাম। পড়ে চমকিত হলাম। পিলে চমকে দেয়ার মতো লেখা। এমন লেখা আগে আর কখনো পড়িনি।

মোখলেস শাহর সন্তান সানু শাহর সুবাদে দু’বার দেখা হলো তাঁর সাথে। একবার এলিফ্যান্ট রোডে তাঁর চেম্বারে। তারপর একদিন গেলাম কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায়, তাঁর বাড়ির দরবারে।

তারপর একদিন তিনি স্বয়ং আসলেন আমাদের গ্রামে। মোখলেস শাহর ওরশে। তা-ও সম্ভবত যুগ পেড়িয়ে গেছে। সে ওরশে হাজার হাজার লোক সমাগম হয়। প্রায় মধ্যরাতে শুরু হয় হয় ভক্তিমূলক ও মুর্শিদি গানের আসর বা সামার মাহফিল।

প্রকৃত ইসলাম যে সুফিবাদের ইসলাম, পীরের কাছে বয়াত হওয়া মানে যে, অহংকার বিসর্জন দেয়া, আর মুসলমান হতে হলে যে পীর ধরতে হবে- এসব কথা তিনি বলছিলেন অবলীলায়। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী মনিষীগণ প্রত্যেকেই যে পীর ধরেছেন, তার প্রমাণস্বরূপ প্রত্যেক বুজুর্গানের পীরের নামসহ তিনি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছিলেন।

সন্ধ্যায় দরবারের দালানের নিচ তলার দক্ষিণ দিকের রুমে বসে তিনি কথা বলছিলেন। সানু কাকা ও আরো কিছু লোকের সাথে আমিও তাঁর কথা শুনছিলাম। সেদিন তাঁর কথা না শুনলে আমার জানাই হতো না যে, মানুষের কথার মধ্যেও এত আকর্ষণ থাকতে পারে!

প্রাণখোলা, সরল, প্রাঞ্জল ও হৃদয় জুড়ানো ভাষা! তাঁর প্রতিটি কথাই ছিলো যেন এক একটা বাণী। শ্রোতাকে আকৃষ্ট করার এক যাদুকরী শক্তি ছিলো তাঁর। তাঁর কথায় ছিলো অন্তরের সরলতা ও ভাষাভঙ্গির সম্মোহনী শক্তি। নির্বাক হয়ে সেদিন আমি শুধু শুনেছিলাম!

তারপর গান শুরুর আগে ওরশের মঞ্চে মাইকে তাঁর ভাষণে ছড়িয়েছিলেন আরও মুগ্ধতা।

প্রকৃত ইসলাম যে সুফিবাদের ইসলাম, পীরের কাছে বয়াত হওয়া মানে যে, অহংকার বিসর্জন দেয়া, আর মুসলমান হতে হলে যে পীর ধরতে হবে- এসব কথা তিনি বলছিলেন অবলীলায়। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী মনিষীগণ প্রত্যেকেই যে পীর ধরেছেন, তার প্রমাণস্বরূপ প্রত্যেক বুজুর্গানের পীরের নামসহ তিনি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছিলেন।

বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি আল্লাহর পাগল-ফকিরদের কারামতি প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলে পিলে চমকে দিলেন। সে ঘটনাটি এমন-

ঢাকার এক ব্যাংকের ম্যানেজার কাজের চাপে জরুরী কিছু কাগজপত্র বাসায় নিয়ে আসে। একদিন বাসা থেকে সে কাগজ উধাও হয়ে যায়। কাগজ না পাওয়া গেলে তাঁর চাকরিতো যাবেই। এমনকি জেল-জরিমানাও হবে। সারা বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজে ও অনেক তদবির করেও যখন কাগজ পেলেন না, ম্যানেজারর পাগল হওয়ার অবস্থা।

তখন ময়মননসিংহে সিরাজ পাগলা নামে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন আল্লাহর এক মাজ্জুব ওলি ছিলেন। ম্যানেজারের এক বোন সিরাজ পাগলাকে মানে, তাঁর ওখানে যাতায়াত করে। কিন্তু ম্যানেজার তার মতো পাগল-ফকিরদের বিশ্বাস করেন না।

ভাই-বোনের সম্পর্ক সাধারণত খুব মমতাপূর্ণ থাকে! ভাই যতই বিরক্ত হোক, বোনের বিশ্বাসে কোন ভাটা পড়ছে না। সে একটা কিছু বুঝ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেই আছে। তৃতীয়বার সুযোগ আসার পর জিজ্ঞেস করল, ‘বাজান! আমার ভাইয়ের কাগজপত্র?’

মতের ভিন্নতা থাকলেও ভাইটির জন্য বোনটির মায়া ছিলো অনেক। ভাইদের জন্য বোনদের মায়া সব সময়ই বেশি থাকে। ‘মায়ের কান্দন সারা জীবন, বোনের ছয় মাস। ঘরের রমণীর থাকে দুই দিন দীর্ঘশ্বাস।’ ম্যানেজার ভাইকে নিয়ে তার বোন একদিন ময়মনসিংহ সিরাজ পাগলার আস্তানায় গেলেন।

তারা গিয়ে দেখে পাগলার সামনে নিত্য দিনের মতো অনেক লোক বসা। লোকজন বিভিন্ন নালিশ করছে। পাগলা নিজের মতো করে ইঙ্গিতে কথা বলছেন। তাঁর রহস্যপূর্ণ কথা কেউ বুঝে, কেউ বুঝে না। বুঝতে না পেরে ভাই অস্থির হয়ে পড়ছে। 

কিন্তু বোন বিশ্বাস করেই বসে আছে। আর ভাইকে বলছে, ভাই, আরেটু বসেন।

অনেকক্ষণ পরে তাদের সুযোগ আসলে, বোন নালিশটি পাগলাকে জানালো।

শুনে পাগলা চুপ করে রইলো। কিছুই বললো না।

ম্যানেজার বোনকে উঠার জন্য আরও জোর দিতে লাগলো। কিন্তু পাগলার প্রতি বোনের অটল বিশ্বাস। ভাইকে সে বললো, ‘ভাই চিন্তা করবেন না, আর একটু বসেন। আসছি যখন, একটা কিছু নিয়েই যাবো।’

আবার সুযোগের অপেক্ষা। অন্যদের নালিশের পরে যখন আবার সুযোগ আসলো, তখন বোন বললো, ‘বাবা! আমার ভাইয়ের কাগজপত্র?’

পাগলা এবার বললেন, ‘ইছবগুলের ভুসি খা!’

ম্যানেজার আরও বিরক্ত হলো। এত সময় অপেক্ষা করে এসব আবোল তাবোল কথা শুনে তার মন ও মেজাজ উভয়ই খারাপ হয়ে গেলো।

ভাই-বোনের সম্পর্ক সাধারণত খুব মমতাপূর্ণ থাকে! ভাই যতই বিরক্ত হোক, বোনের বিশ্বাসে কোন ভাটা পড়ছে না। সে একটা কিছু বুঝ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেই আছে। তৃতীয়বার সুযোগ আসার পর জিজ্ঞেস করল, ‘বাজান! আমার ভাইয়ের কাগজপত্র?’

এবার পাগলা বললেন, ‘ইছব গুলের ভুসি খা! টঙ্গীর বাজার থিকা।’

এবার বোন উঠে পড়লো, ‘ভাই আসেন! আমি উত্তর পাইছি!’

ঢাকা আসার পথে টঙ্গীতে গাড়ি থেকে নেমেই সোজা বাজারে ঢুকে এক মুদি দোকানে গিয়ে বোন জিজ্ঞেস করলো, ‘ইছবগুলের ভুসি আছে?’

দোকানদার বললো, ‘না।’

দ্বিতীয় একটি দোকানে গিয়েও তারা ভুসি পেলো না। তৃতীয় দোকানে গিয়ে বোন ইছবগুলের ভুসির কথা জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার বললো, ‘আছে।’

– এক পোয়া দেন।

দোকানদার কাগজের একটা বাণ্ডেল থেকে একপাতা কাগজ নিয়ে ইছবগুল দিতে যাচ্ছিল। ভাই বিরক্ত ও আশ্চর্য হয়ে বোনের সাথে চলছিল, আর তার কাণ্ড-কারখানা পর্যবেক্ষণ করছিল। এই প্রথম আশ্চর্য হয়ে সে হঠাৎ দেখতে পেলো, দোকানীর হাতে তার অফিসের একটি কাগজ।

বেশ কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন চাচা। গতকাল ভোরে ইন্তেকাল করলেন ভাতিজা। তাঁরা এপারে অসংখ্য মানুষের মধ্যে প্রভুর প্রতি বিশ্বাস-ভক্তি জাগিয়েছেন ও জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছেন। সর্বোপরি তাঁরা মানুষকে শান্তি দিয়ে গেছেন।

ম্যানেজার দোকানদারকে বললো, ‘আরে, রাখেন! রাখেন!’

তারপর কাগজের বাণ্ডেলটি নিয়ে দেখে এখানে তার অফিসের সব কাগজই আছে। দোকানীকে কিছু বকশিস দিয়ে তারা বাণ্ডেল নিয়ে চলে আসে। এসে জানতে পারে, বাসার কাজের মেয়ে অপ্রয়োজনীয় কাগজ ভেবে পুরনো পেপারের সাথে এগুলো বিক্রি করে দিয়েছিল।

তাঁর নাম ডা বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী। তিনি সুরেশ্বর দরবার শরীফের মুরিদ। তাঁকে বলা হয় চেরাগে জান শরীফ। বাংলার আরেক বরেণ্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতি(র)’র আপন ভাতিজা তিনি। সদর উদ্দিন চিশতির ‘কোরান দর্শন’, ‘মসজিদ দর্শন’, ‘ইসলাম ধর্মে মতভেদের কারণ’ মারেফতের জগতে এসব কিতাবও ব্যাপক জনপ্রিয়।

ধর্মীয় গভীর তত্ত্ব ও তরিকতের বিষয়ে ডা বাবা জাহাঙ্গীরের অনেক অডিও ভাষণ রয়েছে। তিনি অনেক বইও লিখেছেন। আমি নিজেই শুনেছি, শুনে অবাক হয়েছি। অনেকেই আমার মতোই অবাক হবেন যে, তিনি নব্বই খণ্ডে পবিত্র কোরানের অনুবাদ করতে চেয়েছিছেন। যা হবে বিশ্বে কোরানের সর্ব বৃহৎ অনুবাদ। শেষ পর্যন্ত সেটা তিনি করে যেতে পেরেছিলেন কি-না জানি না।

স্বল্প সংখ্যক প্রজ্ঞাবান বাঙালির আকাশে এই চাচা-ভাতিজা বাঙালির দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁরা আমাদের আধ্যাত্মিক জগতের মানুষের কাছে বাতিঘর হয়েই থাকবেন।

বেশ কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন চাচা। গতকাল ভোরে ইন্তেকাল করলেন ভাতিজা। তাঁরা এপারে অসংখ্য মানুষের মধ্যে প্রভুর প্রতি বিশ্বাস-ভক্তি জাগিয়েছেন ও জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছেন। সর্বোপরি তাঁরা মানুষকে শান্তি দিয়ে গেছেন।

তাই পরপারে তাঁদের আত্মাও শান্তিপূর্ণ অবস্থানেই থাকবে ইনশাল্লাহ।

……………………………
আরো পড়ুন:
বাবা জাহাঙ্গীর
বাবা জাহাঙ্গীরের বাণী: এক
বাবা জাহাঙ্গীরের বাণী: দুই
বাবা জাহাঙ্গীরের বাণী: তিন
বাবা জাহাঙ্গীরের বাণী: চার
বাবা জাহাঙ্গীরের বাণী: পাঁচ
বাবা জাহাঙ্গীরের বাণী: ছয়
বাবা জাহাঙ্গীরের বাণী: সাত

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Rashidul Islam , বৃহস্পতিবার ২৭ আগস্ট ২০২০ @ ১১:০১ পূর্বাহ্ণ

    ধন্যবাদ। খুব সুন্দর। বাবা জাহাঙ্গীর এর বেশ কিছু বই আমি পড়েছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!